আশুরার দিনের ঘটনা ২০২৫: ইতিহাস, কারবালা, শিক্ষা ও ইসলামী দৃষ্টিকোণ

ইসলামের ইতিহাসে কিছু দিন রয়েছে যা বিশ্বাস, আত্মশুদ্ধি মানবিকতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। এর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিন হলো মহররম মাসের দশম দিন, যাকে বলা হয় "আশুরা" প্রতি বছর এই দিনটি মুসলমানদের জন্য নিয়ে আসে আত্মমূল্যায়ন, ত্যাগ ধৈর্যের অনন্য বার্তা। "আশুরার দিনের ঘটনা ২০২৫" এই প্রেক্ষাপটে আরও তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ বর্তমান বৈশ্বিক ব্যক্তিগত সংকটের মাঝে এটি এনে দেয় আত্মিক প্রশান্তি নৈতিকতার শিক্ষা।

ashurar-diner-ghotona

২০২৫ সালে বাংলাদেশে আশুরা পালিত হয় জুলাই, রোববার ইসলামিক ফাউন্ডেশন ঘোষিত ১৪৪৭ হিজরি সনের পঞ্জিকা অনুযায়ী মহররম শুরু হয় ২৭ জুন। সেই হিসেবে ১০ মহররম হয় জুলাই।

আশুরা কি?

আশুরা হলো হিজরি বছরের প্রথম মাস মহররম-এর দশম দিন, যা ইসলামী ইতিহাসে এক বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিন হিসেবে পরিচিত।আশুরাশব্দটি আরবিআশারা” (عشرة) থেকে এসেছে, যার অর্থ 'দশ' এই দিনটি ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে জড়িত। যেমন, হজরত মূসা (.) বনি ইসরাইলের মুক্তি, হজরত নূহ (.)-এর নৌকার স্থির হওয়া, এবং সবচেয়ে বিখ্যাত ঘটনাকারবালার প্রান্তরে ইমাম হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাত। আশুরা শুধু ইতিহাস নয়, এটি আত্মশুদ্ধি, সত্যের প্রতি অবিচলতা ঈমানি চেতনার প্রতীক। মুসলিম সমাজে এই দিনটি রোজা, দোয়া, আত্মমূল্যায়ন শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে পালন করা হয়।

আশুরার দিনের ঘটনা

ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা অনেকেই জানিনা আশুরার দিনের ঘটনা সম্পর্কে আমি নিচে আশুরার দিনের ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে যে সকল ঘটনা রয়েছে। তার সম্পূর্ণভাবে আলোচনা করছি।

হজরত মূসা (.)-এর মুক্তি ফেরাউনের পতন

আশুরার দিনেই হজরত মূসা (.) আল্লাহর নির্দেশে বনি ইসরাইলকে ফেরাউনের জুলুম থেকে উদ্ধার করেন। লোহিত সাগর চিরে রাস্তা তৈরি হয়, আর ফেরাউন তার বাহিনীসহ ডুবে যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন মদিনায় আসেন, তখন দেখেন ইহুদিরা এই দিন রোজা রাখে। তিনি বলেন:

আমরা হজরত মূসার (.) চেয়ে অধিক হকদার।” — সহিহ মুসলিম: ১১৩০

হজরত নূহ (.)-এর নৌকার স্থির হওয়া

দীর্ঘকাল প্লাবনের পর আল্লাহ তাআলা হজরত নূহ (.)-এর নৌকাকে জুদি পাহাড়ে স্থির করেন এই দিনেই। এটি ছিল মানবজাতির জন্য নতুন যাত্রার সূচনা।

হজরত আদম (.)-এর তওবা কবুল

একাধিক হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, এই দিন হজরত আদম (.)-এর তওবা কবুল হয়। ফলে এই দিনটি আত্মশুদ্ধির প্রতীকও বটে।

হজরত ইব্রাহিম (.)-এর জন্ম

আশুরার দিন হজরত ইব্রাহিম (.)-এর জন্ম হয়েছিল বলেও কয়েকটি বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে। তাঁর জীবন সত্য তাওহিদের পথ দেখায়।

কারবালার শহীদ ইমাম হুসাইন (রা.)-এর আত্মত্যাগ

৬১ হিজরির ১০ মহররম, আশুরার দিনকারবালায় ইয়াজিদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে রাসুল (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র হুসাইন ইবনে আলী (রা.) শহীদ হন। তাঁর সাথে পরিবার সাথীরাও জুলুমের শিকার হন। এই ঘটনা আমাদের শিক্ষা দেয়:

·         সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে হবে

·         অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ফরজ

·         জীবন দিয়ে হলেও ঈমান রক্ষা করতে হবে

আশুরা কবে 2025

২০২৫ সালে ১০ মহররম, আশুরা পালিত হয় জুলাই, রোববার সারাদেশে ইসলামিক ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন সংগঠন দোয়া মাহফিল, আলোচনা সভা, রোজা পালন কারবালা স্মরণে আয়োজন করে।

কিভাবে চার্জ দিলে ব্যাটারি ভালো থাকে?

আশুরার রোজার ফজিলত

আশুরার রোজার ফজিলত ইসলামী শরীয়তে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদাপূর্ণ। রাসুলুল্লাহ (সা.) আশুরার দিনে রোজা রাখতেন এবং সাহাবিদেরও রোজা রাখতে উৎসাহিত করতেন। তিনি বলেছেন,

আশুরার রোজা পূর্ববর্তী এক বছরের গোনাহ মোচন করে।
সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১১৬২

এই রোজা হজরত মূসা (.)-এর ফেরাউন থেকে মুক্তির স্মরণে রাখা হয়, যা ইহুদিরাও পালন করত। তবে ইসলাম মুসলমানদের জন্য রোজাকে আরও পূর্ণতা দিয়েছেরাসুল (সা.) বলেন, ভবিষ্যতে তিনি ১০ অথবা ১০ ১১ তারিখে রোজা রাখার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, যাতে ইহুদিদের অনুকরণ না হয়। আশুরার রোজা শুধু সওয়াবের নয়, বরং আত্মশুদ্ধি, তাওবা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের এক মহা সুযোগ।

পবিত্র আশুরার ইতিহাস

পবিত্র আশুরার ইতিহাস ইসলামী ঐতিহ্যে এক গৌরবময় বেদনাবিধুর অধ্যায়। হিজরি ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস মহররমের দশম দিন আশুরা নামে পরিচিত। এই দিনে ঘটেছে অসংখ্য তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা, যার মধ্যে অন্যতম হলো হজরত মূসা (.)-এর নেতৃত্বে বনি ইসরাইলের মুক্তি ফেরাউনের পতন।

পাশাপাশি, হজরত নূহ (.)-এর নৌকা জুদি পাহাড়ে থেমেছিল আশুরার দিনেই। হাদিসে এসেছে, হজরত আদম (.)-এর তওবা কবুল এবং হজরত ইব্রাহিম (.)-এর জন্মও এই দিনে ঘটেছিল বলে বলা হয়। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো৬১ হিজরির এই দিনেই কারবালার প্রান্তরে ইমাম হুসাইন (রা.) ইয়াজিদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে শহীদ হন। তাই পবিত্র আশুরার ইতিহাস শুধু একটি দিনের স্মরণ নয়, বরং তা সত্য, ন্যায় আত্মত্যাগের চিরন্তন আদর্শ।

আশুরার গুরুত্ব তাৎপর্য

আশুরার গুরুত্ব তাৎপর্য ইসলামের ইতিহাসে এক অনন্য আত্মত্যাগ, ত্যাগস্বীকার নৈতিকতার প্রতীক। এই দিনে একদিকে যেমন স্মরণ করা হয় হজরত মূসা (.)-এর নেতৃত্বে ফেরাউনের পতন বনি ইসরাইলের মুক্তি, অন্যদিকে এই দিনটি মুসলিম উম্মাহর জন্য গভীর বেদনারকারণ ৬১ হিজরিতে কারবালায় ইমাম হুসাইন (রা.) শহীদ হন সত্য ন্যায়ের পতাকা হাতে।

আশুরার দিনটি আমাদের শেখায় কীভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয়, ধৈর্য ধারণ করতে হয় এবং আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা রাখতে হয়। রাসুল (সা.) নিজে এই দিনে রোজা রাখতেন এবং ইবাদতে উৎসাহ দিতেন, যা প্রমাণ করে আশুরা শুধুই ইতিহাস নয়, বরং এটি একটি আত্মিক বিপ্লব নৈতিক উৎকর্ষের দিন। আজকের মুসলমানদের জন্য আশুরার গুরুত্ব তাৎপর্য শুধু স্মৃতির অংশ নয়, বরং জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্তে সত্য ঈমানের পথে চলার অনুপ্রেরণা।

আশুরা সম্পর্কে হাদিস

আশুরা সম্পর্কে হাদিসসমূহে দিনের গুরুত্ব, ফজিলত এবং আমল সম্পর্কে স্পষ্ট নির্দেশনা পাওয়া যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন:

আশুরার রোজা পূর্ববর্তী এক বছরের গুনাহ মোচনের কারণ হয়।
সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১১৬২

তিনি আরও বলেন,

যখন রাসুল (সা.) মদিনায় আসলেন, দেখলেন ইহুদিরা আশুরার দিনে রোজা রাখছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন কেন? তারা বলল, ‘এই দিন আল্লাহ মূসা (.) তার জাতিকে মুক্তি দিয়েছিলেন।তখন রাসুল (সা.) বললেন, ‘আমরা মূসার চেয়ে তার প্রতি অধিক হকদার।অতঃপর তিনি নিজেও রোজা রাখলেন এবং সাহাবিদেরও নির্দেশ দিলেন।
সহিহ বুখারি: হাদিস ২০০৪

এছাড়াও হাদিসে আশুরার দিনে তওবা, দোয়া, সাদকা আত্মমূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে। রাসুল (সা.) আশুরার রোজা শুধু ১০ তারিখে নয়, বরং ইহুদিদের অনুকরণ পরিহার করতে ১০ অথবা ১০ ১১ তারিখ একত্রে রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। তাই আশুরা সম্পর্কে হাদিস আমাদের জন্য শুধুই ইতিহাস নয়, বরং আমল আত্মশুদ্ধির এক নির্ভরযোগ্য পথনির্দেশনা।

আশুরার রোজা কয়টি?

আশুরার রোজা একদিনের হলেও, সুন্নাত অনুযায়ী কমপক্ষে দুই দিন রোজা রাখা উত্তম। রাসুলুল্লাহ (সা.) শুধুমাত্র ১০ মহররমে (আশুরার দিন) রোজা রেখেছেন; তবে তিনি ভবিষ্যতে এবং ১০ অথবা ১০ এবং ১১ মহররম একসাথে রোজা রাখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, যাতে ইহুদিদের সাথে সাদৃশ্য না হয়।

আশুরার নফল নামাজের নিয়ত

অনেক ইসলামিক আলেম আশুরার দিনে বা রাকাত নফল নামাজ পড়ার কথা বলেন, যা ব্যক্তি নিজ ইচ্ছায় আদায় করতে পারেন। এটি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পক্ষ থেকে নির্দিষ্টভাবে প্রমাণিত না হলেও, নফল ইবাদতের মধ্যে এটি উত্তম।

🌙 নামাজের নিয়ত (বাংলায় উচ্চারণ):

আসাল্লি রকআতাইনি সালাতান নাফিলাতান লিল্লাহি তা'আলা।

📖 বাংলায় অর্থ:

আমি দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ার নিয়ত করলাম, আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্যে।

গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর

প্রশ্ন : আশুরার রোজা কেন রাখা হয়?

উত্তর: হজরত মূসা (.)-এর বাঁচার স্মৃতিতে রাসুল (সা.) আশুরার রোজা রাখতেন। রোজা পূর্ববর্তী এক বছরের গোনাহ মাফের উপায়।

প্রশ্ন : ২০২৫ সালে আশুরার তারিখ কী ছিল?

উত্তর: বাংলাদেশে ২০২৫ সালের আশুরা ছিল জুলাই, রোববার।

প্রশ্ন : আশুরার দিনে কী কী আমল করা উচিত?

উত্তর: রোজা রাখা, দোয়া, নফল নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, সাদকা করা।

প্রশ্ন : আশুরা কি শুধুই শোকের দিন?

উত্তর: না। এটি আত্মশুদ্ধি, রোজা, ত্যাগ, আল্লাহর রহমত স্মরণ নৈতিকতার শিক্ষা নেওয়ার দিন। শোকানুষ্ঠান ইসলামের অংশ নয়।

উপসংহার

আশুরার দিনের ঘটনাগুলো আমাদের ইমান, নৈতিকতা দায়িত্ব সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবতে শেখায়। ২০২৫ সালের আশুরা যেন শুধু স্মরণ নয়, বরং হুসাইন (রা.)-এর আদর্শে নিজেকে গড়ার নতুন সূচনা হয়। সত্য ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করাই হবে এই দিনের প্রকৃত সম্মান।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url